লুব্রিকেন্ট সিস্টেম সম্পর্কে আলোচনা

ইঞ্জিনের পিচ্ছিল করণ পদ্ধতিঃ

আমরা জানি ইঞ্জিনের মুভিং পার্টস সমূহকে ঘুরার জন্য ইঞ্জিনের মধ্যে লুব্রিকেটিং পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লুব্রিকেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে এক দিকে যেমন ইঞ্জিনের মুভিং বা ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশ সমূহের ক্ষয় প্রতিরােধ হয়, অন্যদিকে ইঞ্জিনের আয়ুও বর্ধিত হয়। তাছাড়া লুব্রিকেটিং সিস্টেমের উপাদান, এটির প্রেসার নিয়ন্ত্রণ এবং ক্র্যাংকেজ ভেন্টিলেশন সম্পর্কে পর্যাপ্ত আলােচনা করা হয়েছে। আশা করি ছাত্র-ছাত্রীদের উপকারে আসবে। 

দুই বা ততােধিক ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশের মধ্যে তেলের ফিল্ম বা পর্দা উৎপন্ন হয় বলে এদের মধ্যে পিচ্ছিলতা বজায় থাকে। এভাবে ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশের মধ্যে তেলের পদার স্তরে স্তরে ঘর্ষণ হয় এবং ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশ সমূহকে ঘর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করে। 

 
পিচ্ছিল কারক পদার্থ: যে সকল পদার্থ (যেমন- লুব ওয়েল, গ্রিজ) ইত্যাদি ইঞ্জিনের চলমান যন্ত্রাংশের মাঝে চলাচল করে এ যন্ত্রাংশ সমূহকে ক্ষয়ের হাত হতে রক্ষা করে, অথবা তাপের সমতা আনয়ন করতে সাহায্য করে তাকে পিচ্ছিল কারক পদার্থ বলে।

একই ধরনের গুণাগুণ বিশিষ্ট পিচ্ছিল কারক পদার্থ সকল চলমান যন্ত্রাংশের মাঝে ব্যবহৃত হয় না। এটি ইঞ্জিনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যার কোন প্রকার ত্রুটির ফলে ইঞ্জিনের বড় ধরণের ক্ষতি সাধিত হতে পারে এমনকি ইঞ্জিনটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এজন্য লুব্রিকেটিং পদ্ধতিকে ইঞ্জিনের প্রাণ বলা হয়।

ইঞ্জিনের লুব্রিকেশন পদ্ধতি মূলত ইঞ্জিনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশের মাঝে ঘর্ষণ হ্রাস এবং যন্ত্রাংশকে স্বাভাবিক ভাবে চলার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যদি কোন ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশ সরাসরি সংস্পর্শে আসে তাহলে সেখানে ঘর্ষণের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হবে এবং ক্ষয় সাধন হবে। ফলে উক্ত যন্ত্রাংশ দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। ইঞ্জিনের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হলে ইঞ্জিন যে কোন সময় ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তাই এই লুব্রিকেটিং সিস্টেম একটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফুয়েল না থাকলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু লুুব্রিকেশন পদ্ধতি কাজ না করলে ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাবে এমনকি পুরো ইঞ্জিনটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
 

বিভিন্ন প্রকার লুব্রিকেটিং পদ্ধতিঃ-

  1. ছিটানো পদ্ধতি।
  2. চাপ প্রয়োগ পদ্ধতি। 
  3. ছিটানো ও চাপ প্রয়োগ যৌথ পদ্ধতি।
  4. পেট্রো অয়েল পদ্ধতি।
 
ইঞ্জিনের আকার আকৃতি এবং কর্মক্ষমতা ভেদে এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত বড় এবং শক্তিশালী ইঞ্জিনের জন্য ছিটানো এবং চাপ প্রয়োগ যৌথ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

 
লুব্রিকেন্ট হিসাবে বিভিন্ন ধরণের পদার্থ ব্যবহার করা হয়। তবে ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে মূলত সেমি-সলিড লুব্রিকেন্ট এবং লিকুইড লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেমি সলিড লুব্রিকেন্ট হিসেবে গ্রীজ এবং লিকুইড লুব্রিকেন্ট হিসেবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মানের এবং বিভিন্ন গ্রেডের লুব্রিকেটিং অয়েল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার একটি অঞ্চলের পরিবর্তিত আবহাওয়ার সাথে সাথে এই লুব্রিকেটিং অয়েলে গ্রেড ও কিছুটা পরিবর্তন করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

পিচ্ছিল করণ পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্দেশ্যঃ-

  1. পিচ্ছিলকরণ তেল পদ্ধতি ঘুরন্ত যন্ত্রাংশের মাঝে পিচ্ছিলতা বজায় রাখা এবং বিয়ারিং এর মাঝে শ্যাফটকে সুচারু ভাবে ঘুরতে সাহায্য করা।
  2. যন্ত্রাংশের মাঝে ঘর্ষণ কমানো। তবে ঘর্ষণ কোন ভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়।
  3. ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ জনিত তাপ কমানো।
  4. ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশকে শীতল রাখা এবং পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা।
  5. ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশের ঘূর্ণনজনিত সৃষ্ট শব্দ হ্রাস করা।
  6. পিচ্ছিলকরণ তেল দুইটি যন্ত্রাংশের মাঝে সিলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং সেখানে অন্য পদার্থ প্রবেশ করতে দেয় না। 
 

পিচ্ছিলকরণ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ নিম্নরূপঃ-

  1. ক্রাংক কেস বা অয়েল প্যান (Crankcase or Oil Pan)
  2. স্টেইনার (Steiner)
  3. লুব অয়েল পাম্প (Lub-oil Pump)
  4. লুব অয়েল ফিল্টার (Lub-oil Filter)
  5. অয়েল প্রেসার গেজ (Oil Pressure Guage)
  6. অয়েল প্যাসেজ বা অয়েল গ্যালারি (Oil Galary) ইত্যাদি  

পিচ্ছিলকরণ পদ্ধতির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়া হলঃ-

১। ক্রাংক কেস বা অয়েল প্যান (Crankcase or Oil Pan): এটি একটি পাত্র বিশেষ যা ইঞ্জিনের নিচে অর্থাৎ তলদেশে অবস্থান করে। এটি পিচ্ছিলকারক তেল ধারণ করে রাখে।  


২। লুব অয়েল পাম্প (Lub-oil Pump): লুব অয়েল পাম্প মূলত লুব্রিকেটিং অয়েলকে অয়েল প্যান হতে সংগ্রহ করে ইঞ্জিনের বিভিন্ন চলমান অংশে সরবরাহ করে থাকে। এটি মূলত ক্রাংক কেস এর পাশে ক্রাংশ শ্যাফট এর গিয়ার এর সাথে সংযোগ করা থাকে। তবে বেশির ভাগ সময় এটি ক্যাম শ্যাফটের স্পকেট গিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। লুব অয়েল পাম্প মূলত সেন্ট্রিফিউগ্যাল ফোর্সে কাজ করে থাকে। এই পাম্প দুই ধরণের হয়ে থাকে। যথা – রোটর টাইপ লুব অয়েল পাম্প এবং গিয়ার টাইপ লুব অয়েল পাম্প।  

৩। লুব অয়েল ফিল্টার (Lub-oil Filter): ফুয়েল ফিল্টারের মত লুব অয়েল ফিল্টারের কাজ হল লুব্রিকেটিং অয়েলের মধ্য থেকে ময়লা দূর করে অয়েলকে পরিষ্কার করা। কারণ লুব অয়েলের মধ্যে যদি ময়লা থাকে তাহলে তা ঘূর্ণায়মান অংশে গেলে উক্ত সূক্ষ্ম ময়লায় ঘর্ষণের ফলে দ্রুত ক্ষয় হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে লুব্রিকেটিং ক্রিয়া ব্যাহত হবে। তাই লুব অয়েল ফিল্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  


৪। অয়েল প্রেসার গেজ (Oil Pressure Gauge): 
এটি দ্বারা লুব অয়েল পাম্প হতে প্রেরিত লুব অয়েল এর চাপ পরিমাপ করা হয়ে থাকে। লুব অয়েলের চাপ ঠিক না থাকলে ইঞ্জিনের উপরের অংশে ঠিকমত লুব্রিকেটিং অয়েল পৌছাবে না ফলে সেখানকার লুব্রিকেটিং কার্য ব্যাহত হবে। এই গেজ লুব অয়েল পাম্পের ডেলিভারি লাইনের সাথে লাগানো হয়ে থাকে। তাপমাত্রার পরিবর্তনে অয়েল প্রেসার পরিবর্তন হয়।    

৫। অয়েল গ্যালারি (Oil Galary): ইঞ্জিনের অধিকাংশ ঘূর্নায়মান যন্ত্রাংশ যেমন, ক্র্যাংক শ্যাফট, ক্যাম শ্যাফট, ইত্যাদি এর মধ্য দিয়ে চিকন পাইপের মত ছিদ্র থাকে যেখান থেকে লুব অয়েলের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে যেতে পারে এবং সংযোগকৃত জার্নাল ও বিয়ারিং এর মাঝে পৌছাতে পারে। এই ছিদ্র পথকে বলা হয় অয়েল গ্যালারি। লুব অয়েল পাম্পের ডেলিভারি লাইন এই অয়েল গ্যালারির সাথে সংযুক্ত থাকে। 

 

পিচ্ছিলকরণ পদ্ধতির কার্যপ্রণালীঃ- 

লুব্রিকেটিং সিস্টেমে ক্র্যাংক কেস বা অয়েল প্যানের মধে লুব্রিকেটিং অয়েল দ্বারা পূর্ণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে লুব অয়েল পাম্পের সাকশান লাইন এবং একটি স্টেইনার থাকে। লুব অয়েল পাম্পটি মূলত ক্যাম শ্যাফটের স্পকেট গিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। যখন লুব অয়েল পাম্পটি ঘুরে তখন লুব অয়েল পাম্প এর সাকশান লাইন দ্বারা লুব অয়েল স্টেইনার কতৃক পরিশোধিত হয়ে চাপযুক্ত হয়ে ডিসচার্জ লাইন দ্বারা লুব অয়েল ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধিত হয় এবং তা বিভিন্ন পাইপ লাইন এবং ঘুর্ণায়মান যন্ত্রাংশের মাঝের অয়েল গ্যালরি দ্বারা বিভিন্ন জায়গায় সঞ্চালিত হয়ে লুব্রিকেটিং কার্য সম্পাদন করে থাকে। এই লুব অয়েল ইঞ্জিন সিলিন্ডার ওয়াল অথবা লাইনারের গায়েও গিয়ে লাগে এবং পিষ্টন নিচের দিকে আসার সময় তা অয়েল স্ক্রাপার রিং দ্বারা চেছে নিচে নামায় এবং উক্ত লুব অয়েল পুনঃরায় ক্রাংকেসে ফেরত যায়। লুব অয়েল ফিল্টারে লুব অয়েল সঠিকভাবে পরিশোধিত হতে হয়। তা না হলে ক্ষয় হওয়া দানাগুলো লুব অয়েলের সাথে মিশ্রিত হয়ে পুনঃরায় তা যদি ঐ যন্ত্রাংশে ফিরে যায় তখন ক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং লুব্রিকেটিং কার্য ব্যাহত হবে।


তাই নির্দিষ্ট সময়ান্তে লুব অয়েল ফিল্টার এবং লুব অয়েল পরিবর্তন করতে হয়। ছিটকানো পদ্ধতিতে কোন লুব অয়েল পাম্প ব্যবহার করা হয় না। এ পদ্ধতিতে ক্র্যাংক শ্যাফট এর ক্র্যাংক ওয়েভ যখন অয়েল প্যানের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তখন ক্র্যাংক ওয়েভের আঘাতের কারণে লুব অয়েল বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ছিটকে চলে যায়। সাধারণত বড় ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ এবং ছিটকানো এই দুইটি পদ্ধতি একত্রে ব্যবহার করা হয়।


পিচ্ছিলকরণ পদ্ধতি
ছবিঃ পিচ্ছিলকরণ পদ্ধতি


Post a Comment

Previous Post Next Post