ইঞ্জিনের শীতলীকরণ পদ্ধতিঃ
ইঞ্জিনে জ্বালানি দহণের ফলে প্রচুর পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ ৩০০০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড বা তার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু লোহার গলনাঙ্ক মাত্র ১৫০০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। ফলে যদি ঐ তাপমাত্রায় ইঞ্জিন পৌছায় তাহলে ইঞ্জিনের সমস্ত সরঞ্জাম গলে যাবে এমনকি বড় আকারের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য ইঞ্জিনকে একটি নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় রাখা দরকার হয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন বলতে ঐ স্বাভাবিক তাপমাত্রাকে বুঝানো হয় যে তাপমাত্রায় ইঞ্জিনের কোন যন্ত্রাংশের ক্ষতি হবে না এবং ইঞ্জিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কেননা স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে যদি তাপমাত্রা নিচে নেমে যায় তাহলে আবার জ্বালানি প্রজ্জলন ঘটবে না এবং ইঞ্জিন চলবে না। ইঞ্জিনের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট মানে রাখার জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা হল ইঞ্জিনের শীতলীকরণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি আবার নানা ধরণের হয়ে থাকে। ইঞ্জিন ভেদে এর তারতম্য ঘটে থাকে।
নিম্নে শীতলীকরণ পদ্ধতির প্রকারভেদ আলোচনা করা হলঃ
শীতলীকরণ পদ্ধতিকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-
১। মাধ্যমের পার্থক্য অনুসারে শীতলীকরণ পদ্ধতি দুই প্রকার। যথাঃ-
- বাতাশ দ্বারা শীতলীকরণ পদ্ধতি (Air Cooling System)
- পানি দ্বারা শীতলীকরণ পদ্ধতি (Water Cooling System)
২। পানি দ্বারা শীতলীকরণ পদ্ধতি আবার তিন প্রকার। যথাঃ-
- থর্মোসাইফোন পদ্ধতি (Thermo-siphon System)
- পাম্প সঞ্চালিত পদ্ধতি (Pump Circulation System)
- বাষ্পৃভূত পদ্ধতি (Evaporative System)
শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাঃ
- ইঞ্জিনের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখা।
- অতিরিক্ত তাপের হাত থেকে ইঞ্জিনকে বাঁচিয়ে রাখা।
- গ্রীষ্ম প্রধান দেশে ইঞ্জিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
- ইঞ্জিনকে পুড়ে যাওয়া এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো।
শীতলীকরণ পদ্দতিতে ব্যবহৃত যন্ত্রংশ সমূহঃ-
- রেডিয়েটর (Radiator)
- টিউব এবং ফ্রিন্স (tiube and fince)
- ড্রাফট ফ্যান (Draft Fan)
- আপার হোজ পাইপ ও আপার ট্যাংক (Upper House pipe and upper tenk)
- লোয়ার হোজ পাইপ ও লোহার ট্যাংক (Lower House Pipe and lower tenk)
- থার্মোস্টাট ভালভ (Thermostat Valve)
- ওয়াটার পাম্প (Water Pump)
- ওয়াটার জ্যাকেট (Water Jacket)
- টেম্পারেচার মিটার/গেজ (Temperature Gauge)
নিম্নে শীতলীকরণ পদ্ধতির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ-
১। রেডিয়েটর (Radiator): এটি ইঞ্জিনের সামনের অংশে অবস্থিত এক প্রকার জালি বিশেষ যার উপরে এবং নিচে একটি ট্যাংক আছে। উক্ত ট্যাংকে পানি রিজার্ভ করে রাখা হয়। তা ছাড়া উক্ত জালি যাকে ফিনস্ বলা হয় এর মধ্য দিয়ে অসখ্য চিকন পানির পাইপ বিদ্যমান যা বাইরের বাতাস দ্বারা এর ভেতরে অবস্থিত পানিকে ঠান্ডা করে থাকে। এই পাইপগুলোকে বলা হয় রেডিয়েটর কোর। এগুলো রেডিয়েটরের আপার ট্যাংক এবং লোয়ার ট্যাংকের সাথে ঝালাই করে লাগানো থাকে। রেডিয়েটরের উপরে একটি প্রেসার ক্যাপ এবং এটি অভার ফ্লো পাইপ থাকে যা হতে অতিরিক্ত উপচে পড়া পানি বাইরে পড়ে গিয়ে রেডিয়েটরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
২। টিউবঃ টিউব হচ্ছে শুরু চিকন এর ভিতর দিয়ে পানি চলাচল করে এবং ফিন্স পানি থেকে তাপ শুষে নেয়।
৩। ড্রাফট ফ্যান (Draft Fan): এটি রেডিয়েটরের পিছনে লাগানো এমন এক প্রকার ফ্যান যা বাইরের বাতাসকে টেনে ভিতরের দিকে নিয়ে আসে। উক্ত বাতাসে রেডিয়েটর কোর এবং এর ভিতরে অবস্থিত পানি ঠান্ডা হয়। এটি ক্র্যাংক শ্যাফট এর প্রান্তে লাগানো পুলি ও বেল্ট এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে।
৪। আপার হোজ পাইপ (Upper House Pipe): এটি রেডিয়েটরের উপরের অর্থাৎ আপার ট্যাংকের সাথে লাগানো থাকে। এই পাইপ দ্বারা গরম পানি ওয়াটার জ্যাকেট হতে রেডিয়েটরে আসে। এ পানি মূলত ইঞ্জিনের তাপ শোষন করে গরম হয়ে যায় যা রেডিয়েটরে এসে আবার ঠান্ডা হয়। এই পাইপের মুখে থার্মোস্টাট ভালভ লাগানো থাকে।
৫। লোয়ার হোজ পাইপ (Lower House Pipe): এটি রেডিয়েটরের লোয়ার ট্যাংকের সাথে সংযুক্ত থাকে। এই পথ বা পাইপ দিয়ে ঠান্ডা পানি ইঞ্জিনের ওয়াটার জ্যাকেটে প্রবেশ করে ইঞ্জিনকে ঠান্ডা করে থাকে। এই পাইপের মুখে ওয়াটার পাম্প লাগানো থাকে।
৬। থার্মোস্টাট ভালভ (Thermostat Valve): এটি মূলত রেডিয়েটর এবং ওয়াটার জ্যাকেটের মধ্যে পানির প্রবাহের নিয়ন্ত্রন ঘটিয়ে থাকে। এটি তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাসের সাথে সাথে খোলে এবং বন্ধ হয়। যখন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায় তখন এই ভালভ বন্ধ হয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। আবার যখন ইঞ্জিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায় তখন এই ভালভ খুলে গিয়ে পানির প্রবাহ ঘটায় এবং ইঞ্জিনের তাপমাত্রা হ্রাস করে। এই ভালভ স্বয়ক্রিয় ভাবে পরিচালিত হতে পারে। একে পরিচালনা করার জন্য বাইরে থেকে আলাদা কোন মেকানিজমের প্রয়োজন হয় না।
৭। ওয়াটার পাম্প (Water Pump): এটি মূলত ইঞ্জিনের শীতলীকরণ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত পানিকে বিভিন্ন অংশে পরিচালনা করে থাকে। এটি ক্রাংক শ্যাফট এর প্রান্তে লাগানো পুলি ও বেল্ট এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে।
৮। ওয়াটার জ্যাকেট (Water Jacket): ইঞ্জিন সিলিন্ডারের চারপাশে পানি চলাচলের কিছু ফাঁকা যায়গা রাখা হয় যেখানে ঠান্ডা পানি এসে ইঞ্জিনের তাপমাত্রা হ্রাস ঘটিয়ে থাকে। ওয়াটার পাম্পের মাধ্যমে এই পানি ওয়াটার জ্যাকেটে প্রবেশ করে। এই পনি ওয়াটার জ্যাকেট হতে তাপ শোষণ করে পুনঃরায় রেডিয়েটরে ফিরে যায়।
৯। টেম্পারেচার গেজ (Temperature Gauge): এটি ইঞ্জিনের তাপমাত্রা নির্দেশ করে থাকে। টেম্পারেচার গেজ দ্বারা ইঞ্জিনের তৎক্ষণাৎ তাপমাত্রা কত তা জানা যায়।
ইঞ্জিনের শীতলীকরণ পদ্ধতির কার্যপ্রণালীঃ-
শীতলীকরণ পদ্ধতিতে রেডিয়েটরের ট্যাংকগুলো এবং ওয়াটার জ্যাকেট বিশুদ্ধ পনি দ্বারা পূর্ণ করা হয়ে থাকে। এখানে ময়লা এবং দূষিত পানি ব্যবহার করলে ইঞ্জিনের বিভিন্ন ধাতব যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যখন ইঞ্জিন চলে তখন ড্রাফট ফ্যানের বাতাস দ্বারা রেডিয়েটরের পানি ঠান্ডা হয় এবং ওয়াটার পাম্পের মাধ্যমে এ পানি ইঞ্জিনের ওয়াটার জ্যাকেটে প্রবেশ করে। ঐ ঠান্ডা পানি ইঞ্জিনের তাপ শোষণ করে নিজে গরম হয় এবং আপার হোজ পাইপ দিয়ে রেডিয়েটরের আপার ট্যাংকে ফিরে আসে। আপার হোজে সংযুক্ত থার্মোস্টাট ভালভ ইঞ্জিনের তাপমাত্রা ভেদে এই পানির প্রবাহের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। আপার ট্যাংক হতে গরম পানি রেডিয়েটর কোরের মধ্য দিয়ে নিচের দিকে অর্থাৎ লোয়ার ট্যাংকে যায়। লোয়ার ট্যাংকে যাওয়ার সময় এই পানি ড্রাফট ফ্যান হতে সরবরাহকৃত বাতাস দ্বারা ঠান্ডা হয়। তা আবার ওয়াটার পাম্পের মাধ্যমে ওয়াটার জ্যাকেটে ফিরে যায়। এভাবে চক্রাকারে শীতলীকরণ প্রকৃয়া চলতে থাকে। তাবে এ প্রকৃয়ায় অবশ্যই বিশুদ্ধ এবং পাতিত পানি অর্থাৎ ডিসটিল্ড ওয়াটার ব্যবহার করতে হবে। কারণ পানিতে থাকা ক্ষার এবং বিভিন্ন অপদ্রব্য ইঞ্জিনের ধাতব অংশের ক্ষতি সাধন করে থাকে। অনেক সময় দূষিত পানির কারণে রেডিয়েটরের টিউবগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত চাপে টিউবগুলো ফেটে যেতে পারে। তাই রেডিয়েটরে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা আবশ্যক। অনেক ছোট ইঞ্জিনে শুধুমাত্র বাতাস দ্বারা শীতলীকরণ কার্য সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এতে অনেক সময় ফ্যান ব্যবহার করা হয় আবার কখনও কখনও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক প্রবাহিত বাতাস দ্বারাই শীতল করা হয়। সে ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের গায়ে অনেক সংখ্যক ফিনস থাকে যেখানে বাতাস আটকে গিয়ে ইঞ্জিনকে ঠান্ডা করে থাকে।
<ছবিঃ ইঞ্জিনের শীতলীকরণ পদ্ধতি |